ইরানে নজিরবিহীন সামরিক অভিযান চালিয়েছে ইসরায়েল। বৃহস্পতিবার দিবাগত রাত সাড়ে তিনটার দিকে শুরু হওয়া এ অভিযানে হামলার লক্ষ্যবস্তু করা হয়েছে দেশটির পারমাণবিক প্রকল্প, ক্ষেপণাস্ত্র উৎপাদনকেন্দ্র ও আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা।
এ হামলায় ইরানের সেনাপ্রধানসহ অন্তত ২০ জন সামরিক কমান্ডার নিহত হয়েছেন বলে দেশটির রাষ্ট্রীয় সংবাদমাধ্যমগুলো জানিয়েছে।
ইসরায়েল তাদের এই অভিযানের নাম দিয়েছে ‘অপারেশন রাইজিং লায়ন’। প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র কর্মসূচি ঠেকাতেই এ অভিযান শুরু হয়েছে এবং হুমকি যতদিন থাকবে, ততদিন এ অভিযান চলবে।
ইরানের তেহরান শহর থেকে ২২৫ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত নাতাঞ্জ পারমাণবিক স্থাপনায় ইসরায়েলের এ হামলা চালানো হয়। স্থানীয় সময় বৃহস্পতিবার গভীর রাতে শহরের বিভিন্ন আবাসিক এলাকায় বিস্ফোরণের শব্দে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ে। নাতাঞ্জের বাসিন্দা মারজিয়েহ রয়টার্সকে বলেন, “কানে তালা লাগা শব্দে ঘুম ভেঙে যায়। সবাই দৌড়ে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। সন্তানদের নিয়ে নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।”
ইসরায়েলের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে, তারা ইরানের অন্তত আটটি শহরে শতাধিক স্থাপনায় আঘাত হেনেছে। এসব হামলায় অংশ নেয় প্রায় ২০০টি যুদ্ধবিমান।
হামলায় ইরানের ইসলামি রেভোল্যুশনারি গার্ড কোরের প্রধান কার্যালয় মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এতে বাহিনীপ্রধান হোসেইন সালামি নিহত হন। একই সঙ্গে ইরানের সেনাপ্রধান মেজর জেনারেল বাঘেরি, বিমানবাহিনীর কমান্ডার আমির আলী হাজিজাদেহ এবং আরও অন্তত ২০ জন ঊর্ধ্বতন সামরিক কর্মকর্তা নিহত হয়েছেন। হামলার সময় হাজিজাদেহ ও তাঁর সহকর্মীরা একটি ভূগর্ভস্থ কমান্ড সেন্টারে বৈঠকে ছিলেন, যা সম্পূর্ণভাবে ধ্বংস হয়ে গেছে।
নিহতদের মধ্যে ছয়জন ইরানি পরমাণুবিজ্ঞানী রয়েছেন বলে নিশ্চিত করেছে ইরানের রাষ্ট্রীয় সংবাদ সংস্থা।
হামলার পরদিন শুক্রবার রাতেই ইসরায়েলের তেল আবিবসহ বিভিন্ন শহরে শত শত ক্ষেপণাস্ত্র ও রকেট ছুড়ে প্রতিশোধ নেয় ইরান। তেল আবিবে একটি বহুতল ভবনে বিস্ফোরণ ঘটার পাশাপাশি ১৫ জন আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে।
ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানায়, তাদের আকাশ প্রতিরক্ষাব্যবস্থা সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং সাধারণ নাগরিকদের নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়। এদিকে ইরান দাবি করেছে, তারা ইসরায়েলের দুটি যুদ্ধবিমান গুলি করে ধ্বংস করেছে।
ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি হামলার নিন্দা জানিয়ে বলেন, “ইসরায়েল যুদ্ধ শুরু করেছে এবং এর কঠিন পরিণতি ভোগ করতে হবে।”
পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাগচি জাতিসংঘকে পাঠানো চিঠিতে বলেন, “এ হামলা ইরানের সার্বভৌমত্বের ওপর সরাসরি আঘাত, যা যুদ্ধ ঘোষণার শামিল।” তিনি দ্রুত জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের জরুরি বৈঠকের আহ্বান জানান।
ইসরায়েলের সেনাপ্রধান আইয়াল জামির জানিয়েছেন, যুদ্ধের আশঙ্কায় ইতোমধ্যে ১০ হাজারের বেশি সেনা মোতায়েন করা হয়েছে। তিনি বলেন, “যে কেউ আমাদের চ্যালেঞ্জ জানাবে, তাকে বড় মূল্য দিতে হবে।”
ইসরায়েলের ঘনিষ্ঠ মিত্র যুক্তরাষ্ট্র হামলার ব্যাপারে পূর্বেই অবগত ছিল বলে জানিয়েছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প। ফক্স নিউজকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি জানান, হামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনীর কোনো ভূমিকা না থাকলেও ইসরায়েলের পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতেন তিনি।
উল্লেখ্য, হামলার আগেই মধ্যপ্রাচ্য থেকে কিছু মার্কিন কূটনীতিককে সরিয়ে নেওয়া হয়েছিল এবং দূতাবাসগুলোতে জারি করা হয় সতর্কতা।
ইরানের ভূখণ্ডে এত বড় সামরিক অভিযান ১৯৮০-এর দশকের ইরান-ইরাক যুদ্ধের পর এই প্রথম। এ ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছে রাশিয়া, চীন, যুক্তরাজ্য, জর্ডান, কাতার ও ওমান।
জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস ইরান ও ইসরায়েলকে সর্বোচ্চ সংযত থাকার আহ্বান জানিয়ে বলেন, “এই সংঘর্ষ আর যেন না বাড়ে।”