প্রিন্ট এর তারিখঃ জুন ১৯, ২০২৫, ৩:১৯ এ.এম || প্রকাশের তারিখঃ জুন ১৪, ২০২৫, ৯:৫৩ এ.এম
জনগণের চোখে সরকার এখনো ‘শত্রু’ : প্রধান উপদেষ্টা
বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পতনের এক বছর পরও জনগণ সরকারকে তাদের ‘শত্রু’ হিসেবেই দেখে।
তিনি মনে করেন, দেশজুড়ে ছড়িয়ে পড়া দুর্নীতি নির্মূল করাই একটি ‘নতুন বাংলাদেশ’ গঠনের মূল চাবিকাঠি।
‘সরকারকে শত্রু মনে করে মানুষ’
নোবেল শান্তি পুরস্কারপ্রাপ্ত ড. ইউনূস সম্প্রতি ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম দ্য গার্ডিয়ানকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, সরকার থেকে গ্রাম—প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি ঘিরে রেখেছে নাগরিকদের জীবন। ঘুষ ছাড়া কিছুই সম্ভব নয়, পাসপোর্ট থেকে শুরু করে ব্যবসার লাইসেন্স—সব ক্ষেত্রেই মানুষকে দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে।
তিনি বলেন, "কেউ না কেউ সবসময় বিপুল অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার জন্য অপেক্ষা করছে। মানুষ বিশ্বাস করে সরকার তাদের শত্রু, এবং সেই শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করেই তাদের জীবন কাটাতে হয়।"
আন্দোলনের পেছনে ক্ষোভ আর দুর্দশা
২০২৪ সালের জুলাইয়ে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর ইউনূস অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নেন। আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল সরকারি চাকরিতে কোটা পদ্ধতির বিরুদ্ধে ছাত্রসমাজের অসন্তোষ থেকে, তবে এর গভীরে ছিল জীবনযাত্রার ব্যয়বৃদ্ধি, বেকারত্ব এবং সম্ভাবনার অভাব।
হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে কর্তৃত্ববাদী শাসন, বিরোধী দলের দমন এবং বাকস্বাধীনতা হরণের অভিযোগ ছিল প্রবল। সেই সঙ্গে ব্যাংকিং খাতের ভাঙন এবং রাজনৈতিক অভিজাতদের দুর্নীতিও ছিল অন্যতম কারণ।
‘আমরা পেয়েছিলাম এক বিধ্বস্ত দেশ’
ইউনূস বলেন, “আমরা শুরুর সময় পেয়েছিলাম এক বিধ্বস্ত অর্থনীতি, ভেঙে পড়া প্রশাসন। কেউ জানত না পরবর্তী মাসে বিদ্যুৎ বিল দেওয়া সম্ভব হবে কি না।” ব্যাংকগুলোর দেওয়া ঋণকে তিনি ‘উপহার’ আখ্যা দিয়ে বলেন, “এগুলো আদতে ঋণ ছিল না—ফেরত আসেনি কখনো।”
সংস্কার চুক্তি নিয়ে আশাবাদ, তবে চ্যালেঞ্জ বড়
বর্তমানে অন্তর্বর্তী সরকার নির্বাচন, দুর্নীতি দমন ও জনকল্যাণ বিষয়ে কমিশনের প্রস্তাবিত সংস্কার বাস্তবায়নে কাজ করছে। ইউনূস চান, ‘জুলাই সনদ’ নামে পরিচিত ঐতিহাসিক দলিলটি অভ্যুত্থানের এক বর্ষপূর্তির আগেই চূড়ান্ত করা হোক, যাতে এপ্রিলের নির্বাচনের আগে বাস্তবায়নে অগ্রগতি সম্ভব হয়।
“এই দলিলটি হালকা কিছু নয়, বরং এটি মৌলিক পরিবর্তনের রূপরেখা দেবে,” বলেন ইউনূস। তবে তিনি স্বীকার করেন, রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে ঐক্য অর্জন সহজ হবে না।
বিএনপি, যেটি বর্তমানে সবচেয়ে শক্তিশালী দল, তারা দ্রুত নির্বাচন চায় এবং প্রধানমন্ত্রীর জন্য দুই মেয়াদের সীমাবদ্ধতার বিরোধিতা করছে।
‘সমালোচনা আসবেই, তবে কাজ থামানো যাবে না’
তিনি বলেন, "আগে আমি আওয়ামী লীগের সমালোচনার লক্ষ্য ছিলাম, এখন সব পক্ষ থেকেই সমালোচনা আসে। কিন্তু এটি গ্রহণ করতে হয়। এটাই রাজনীতির বাস্তবতা।"
ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক উদ্যোগে নতুন চিন্তা
জনগণের জন্য রাষ্ট্রের দায়িত্ববোধ বাড়াতে তিনি স্বাস্থ্যসেবা ও সামাজিক উদ্যোগে অলাভজনক মডেলকে উৎসাহিত করতে চান। ক্ষুদ্রঋণ খাতকে এনজিও নির্ভরতা থেকে সরিয়ে আনতে তিনি চাইছেন বিশেষায়িত ক্ষুদ্রঋণ ব্যাংক।
যদিও উচ্চ সুদের কারণে এই খাত সমালোচিত, তবুও ইউনূস বলেন, “ক্ষুদ্রঋণ নিজেই কোনো ভুল নয়। বরং এটি দরিদ্র মানুষের ক্ষমতায়নের একটি কার্যকর পন্থা।”
আগামী এপ্রিলের নির্বাচনকে সামনে রেখে ইউনূসের নেতৃত্বে চলমান এই রূপান্তরমূলক পথচলা কতটা বাস্তবায়ন সম্ভব হয়—তা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। তবে অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যক্রম অন্ততপক্ষে এক নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার সন্ধান দিয়েছে।